কলকাতার এই বাড়িটার তিনতলায় আমরা থাকি। আমাদের বুদবুদের বাড়িতে যেমন একটা বাড়ির সাথে অন্য একটা বাড়ির অনেকটা গ্যাপ,এখানে সেটা নেই একটা বাড়ির জানলার সাথে অন্য বাড়ির জানালা ছাদের দূরত্ব খুবই কম। একটা জানলা খুললে অন্য বাড়ির উচ্চতা অনুযায়ী জানলা বা ছাদ ছাড়া কিছুই দেখা যাবেনা তাই যথারীতি অন্যবাড়িতে থাকা মানুষগুলির টুকিটাকি আওয়াজ ,কাজকর্ম সবই আমরা দেখতে ও শুনতে পায়। কোন বাড়িটায় কে থাকে শুধু এইটুকু ছাড়া আমি যদিও কিছুই বুঝতে পারিনা, কিন্তু এক্ষেত্রে আমার মা ভীষন পারদর্শী , নিজের মতো বানিয়ে নেয় আবার মাঝে মাঝেই কে কার দাদু , কে কার কাকা হিসেব মেলাতে পারেনা,অস্বস্তিতে পড়ে যায় ।এসে বলে “সামনের ওই অদ্বিতীয়া apartment এ একটা তোর বয়সী মেয়ে থাকে ,মায়ের সাথে.. কোনো দিন গলার আওয়াজ পেয়েছিস? জানতেই পারবেনা কেউ, খুব ভালো মেয়ে,তোর মত নাকি / চার তলায় দুটো আমাদের মত মহিলা আর একটা বুড়ো থাকে,ওরা কি দুই বোন না মা-মেয়ে ?কি জানি.. বুড়োটা তাহলে কে? ওরা বোনই হবে বুঝলি!”।
এখানে শুধু আমি আর মা তাই বাড়ির থেকে কাজ অনেকটাই কম। আমি University চলে গেলে মা একেবারেই একা ,সম্বল বলতে ওই ফোনের কটা সিরিয়াল আর বেলকুনি দিয়ে রাস্তার ফেরিওয়ালা ,আশপাশের লোকজনদের দেখে নানানরকম assumption করা এইটুকুই (ইদানিং কটা বান্ধবী হয়েছে ,নীচে যায় গল্প করে)। আমাকে এসে যখন এইসব গল্প গুলো করে ,বেশিরভাগ সময় ইচ্ছে না করলেও শুনি ,আবার মাঝেমধ্যে বিরক্তও হয় parallally।
এইবার আসল কথায় আসি, আসলে আমার সময় হলে আমিও দেখি । ছাদে যায় .. কে কার ছাদে কি করছে ,অন্যদের ছাদের টবে লাগানো গাছ গুলো .. যেটুকু দেখা যায় আর কি!প্রতিদিন বিকেলে ফাঁকা রাস্তায় বাচ্চাদের খেলা , একজন রোজ হারমোনিয়াম নিয়ে বসে রেওয়াজ করে ,একটি বাচ্চা মেয়ে ফোন নিয়ে বিকেলে ছাদে বসে reels বা tiktok কিছু একটা করে ,খেলে না , খুব রাগ হয় আমার , আমি যে ওর দিকে তাকিয়ে আছি এইটা একদিন আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে ওর মাকে বলছিল ..লক্ষ্য করেছি আমি। কেউ শুধু রোজ ফোনে কথা বলতেই ছাদে ওঠে , কেউ এমনিই ঘুরে বেড়ায় , গান শোনে। আর দেখি আকাশ , পাখি আর এরোপ্লেন।
যেটা লিখবো ভেবে এতকিছু লেখা হয়ে গেলো সেটা বলি এইবার। আমাদের এই বাড়িটার পিছনদিকএর জানলার একটু সামনে , একটি বাড়ির সামনের দিক দিয়ে হলে বাম দিকটা পড়ে , তার তিন তলায় দুটো বাচ্চা সহ মা আর বাবা থাকে ,আজকাল ওদের দেখতে আমার খুব ভালো লাগে , কে জানে কেন। পিছনের এই জানলা টা দিয়ে খুব হাওয়া দেয় , মাঝে মাঝেই গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ওখানটায় । ঝগড়া-ঝাঁটি , কলহ , ডিভোর্সের যুগে একটা সুখী পরিবার দেখলে বোধহয় এমনটাই অবাক হয় মানুষ , আমিও তাই হচ্ছি মনে হয় , অকারনেই আনন্দ পাচ্ছি ওদের দেখে । দুটো বাচ্চা একজন হাঁটতে পারে আর একজন কোলে , কে মেয়ে কে ছেলে কিছুই বুঝতে পারিনা , কিন্তু সন্ধ্যে হলেই বাবা টি একজন কে কাঁধে আর একজন কে কোলে নিয়ে গান চালিয়ে নাচতে থাকে , চারজন মিলে একটা হাওয়ায় ফোলানো ফুটবল নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলে । বিকেলে ছাদে যায় , চারজন একসাথে বসে থাকে হাওয়া খায় বাচ্চাগুলোকে এরোপ্লেন দেখায় , আজ দেখলাম যে বাচ্চাটি একটু বড়ো সে তার বাবার মাথায় খেলনা দিয়ে উদুম পেটাচ্ছে আর বাবা যন্ত্রণায় কাতরানোর অভিনয় করছে , ইতিমধ্যে মা এসে একটু বকে! হাত দিয়ে আদর করতে শেখালো আর নিমেষেই বাবার যন্ত্রণা ঠিক হয়ে গেলো। আর এখন রাত ১১ টা বাজছে, দেখলাম মা.. টি – বাবা টিকে ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে , এতই ভালো লাগলো যে আর থাকতে না পেরে লিখতে শুরু করে দিলাম । জানি Right to privacy লঙ্ঘন হচ্ছে ,জানি! কিন্তু তাও দেখছি ভালো লাগছে ওদের সুখটা সচক্ষে অনুভব করতে। দূর থেকে নাকি সবই জল আর সামনে গেলে মরীচিকা,কিন্তু তাও ওদের বাড়ির ভেতরের অসুখ , অভাব গুলো জানার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই ,এই মরীচিকাটা না হয় আমি দূর থেকেই উপভোগ করি। প্রতিদিন খবরের কাগজ , টিভি , ফেসবুক থেকে জানতে পারা হিংস্রতার – বর্বরতার খবর গুলো আমার জন্য যথেষ্ট। সিনেমার পর্দার মত এই আনন্দময় scene গুলো যেন এইরকমই একই থাকে , এই বাড়িতে আমার স্থায়ীত্ব আর খুব জোড় দেড় মাস ,কিন্তু এরপর যারা এখানে থাকতে আসবে তাদের মধ্যেও কেউ একজন যেন আমার মত ওদের নিয়ে গল্প লেখে , বাচ্চা গুলোর হেসে – খেলে বেড়ে ওঠার গল্প, আর সেই গল্প যেন আমার অবধি পৌঁছায় । ওদের এই আনন্দময় জীবন চিরস্থায়ী হোক এই কামনা।
— Avidha
——-
Stay Safe
Be Happy
Thanks a lot for visiting.
_________
You must be logged in to post a comment.