—– Avidha Goswami
লক্ষ্মীর সাথে আজ আবার অনেক গল্প করেছি, ওর গল্পগুলো বেশ interesting লাগে আমার , রং চড়িয়ে সুন্দর ভাবে গল্প বলার এক বিরাট প্রবণতা আছে ওর মধ্যে । আজ আমরা দুজনেই ওর গল্প শুনেছি খুব মন দিয়ে,আজকের গল্প ছিল ওর নিজের জীবনের । আমার থেকে এক বছরের ছোট বা আমারই বয়সই হবে হয়তো ,তাই নাম ধরেই ডাকি ওকে আর ও আমাকে দিদি বলে সম্বোধন করে , প্রথম দিন থেকেই। মাধ্যমিক এ বিশাল রেজাল্ট করেছিল নাকি ও,তাও আবার সব সাবজেক্ট এর teacher ছাড়ায় । ওর বাবা সামান্য construction লেবার, মা লোকের বাড়ি কাজ করতো ,তিন বোন নিয়ে ওরা মোট ছিল পাঁচ জন। বাবার পক্ষে সম্ভব ছিলনা তিন জন কে খাইয়ে- পরিয়ে আবার সব বিষয়ে আলাদা করে করে মাস্টার- মশাই দেওয়ার, কোনক্রমে দুটো বিষয়ে ; অঙ্ক আর ইংলিশ, এই দুটো সাবজেক্ট এর জন্য টিউশন নিতে পেরেছিল সে তাও আবার পাশের বাড়ির পাতানো কর্মরত দাদার সাহায্যে । মা সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তো কাজে , বাড়ির যাবতীয় কাজ করতো আমাদের লক্ষ্মী , বড়ো বোন বলে কথা । বাবার সাথে তো দেখায় হতনা ওদের, বাবা বেড়োতো ভোরে আর বাড়ি ফিরত যখন, তখন ওরা তিন বোনে গভীর নিদ্রায় । ছুটি বলে তো কিছুই ছিলনা তেমন, হ্যাঁ পয়লা মে ; ওই একটা দিন ওর বাবার ছুটি থাকতো । তিন বোন মিলে বাবাকে আঁকড়ে ধরতো ,কে আগে কার গল্প শোনাবে সেই নিয়ে বাঁধতো ঝগড়া – ঝাঁটি । বাবা তিন বোনকেই ভীষণ ভালোবাসতো , ছেলে নেই বলে তেমন আপসোস কোনদিনই ছিল না লক্ষ্মীর বাবার।
মেজো বোন ; দূর্গার সাথে লক্ষ্মীর বয়সের পার্থক্য খুব বেশি ছিলনা লক্ষ্মী যখন ষোলো দূর্গা তখন তেরো প্লাস। ছোটো বোনটা দুজনের থেকে অনেকটাই ছোটো ,ওর নাম সরস্বতী। সরস্বতী নাকি লক্ষ্মীর চেয়েও পড়াশোনায় এক কাঠি উপরে। বাবা সখ করে তিন জনের নাম দেবী দের নামে রেখেছিল। দূর্গা আবার ছিল খেলা – ধূলায় পারদর্শী , তার কোনদিনই তেমন পড়াশোনায় মন ছিলনা । মা – বাবা দুজনের রোজগারে হেসে – খেলে ভালোই দিন কাটতো ওদের, কিন্তু ওই অদৃষ্ট শক্তিটি সবাইকে সারা জীবন শান্তিতে থাকতে দেয় কোথায় …
লক্ষ্মীর মায়ের গভীর অসুখ ধরা পড়লো, সারা শরীরে নাকি জল জমে গেছিলো, হাত – পা , ফুলে উঠছিল দিনে দিনে । পাড়ার মোঁড়ের চেম্বারে বসতো ঘোষ ডাক্তার অনেকরকম পরীক্ষার পর উনি বলেছিলেন , মাকে এবার বেড- রেস্ট এ থাকতে হবে । শুরু হলো সংসারে টানাটানি, কদিনের মধ্যে লক্ষ্মীর মাধ্যমিক এর রেজাল্ট বেরোলো , চারটে বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়েছিল লক্ষ্মী। বাবা গর্বের সাথে সারা পাড়া রটিয়ে বেরিয়েছিল তার মেয়ের সুকীর্তির কথা।
পাশের বাড়ির দাদা একটু দূরের একটা স্কুলে ভর্তিও করে এসেছিল আর্টস এই । বাবা খুব খুশি হয়ে সেদিন ওকে সহমতি দেয়নি যদিও, তাও না বলেনি একবারও মুখ ফুটে , বড্ড ভালোবাসতো কিনা, অনেক স্বপ্নও তো দেখেছিল লক্ষ্মীদের নিয়ে তাই।
পাড়ার পাল কাকু শনিবার রাতে ওদের বাড়ি এসেছিল , একটা গভীর আলোচনা চলছিল বাবা আর পাল কাকুর মধ্যে । লক্ষ্মী তখন খানিকটা বড়ো হয়েছে , একটু আঁচ যে সে পায়নি তা নয় । সোমবার রাতে একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছিল বাবা । ওরা যখন সবাই একসাথে খেতে বসলো , বাবা একটু আমতা আমতা করে লক্ষ্মীকে বললো ,
– লক্ষ্মী মা , পাল দা তোর জন্য একটা পাত্রের খোঁজ দিয়েছে রে , আমারও বেশ ভালো লেগেছে সব শুনে , তোর মাকেও বলেছি । কাল ওরা তোকে দেখতে আসবে বলেছে ।
লক্ষ্মীর পা থেকে মাটি টা কেমন সরে যাচ্ছিলো , চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলো সে, এত স্বপ্ন , এত এত আশা সব যেনো এক মুহূর্তে কোথায় যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। লক্ষ্মী তখন বাড়ির বড়ো মেয়ে , সে বুঝতে পেরেছিল বাবা তাদের এই দুর্দশার দিনে অনেক কিছু ভেবে – চিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।
বাবা জিজ্ঞেস করলো ;
– কিরে ? তুই কি বলিস মা ..
লক্ষ্মী সব ভুলে নির্বিঘ্নে বাবার কথায় ঘাড় নেরে সহমতী দিল।
সেদিন রাত্রে ঘুমাতে পারেনি লক্ষ্মী সারারাত প্রবল যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করেছিল আর কেঁদেছিল , সে বুঝেছিল এই তার নিয়তি এর থেকে পালাবার আর কোনো উপায় নেই তার কাছে । বাবা সকাল থেকে মেয়ের মুখোমুখি হতে পারেনি সেদিন , চোখে চোখ রাখতে পারেনি যেন বিরাট একটা অপরাধ করতে বসেছে সে । যথারীতি পাত্র পক্ষ দেখতে এলো ওকে , সেদিন পাশের বাড়ির কাকিমা লাল শাড়ি আর মাথায় ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল লক্ষ্মীকে । পটে আঁকা লক্ষ্মী ঠাকুরের মতই লাগছিলো লক্ষ্মীকে । সেদিনই আশীর্বাদও করে , পাঁকা কথা বলে , বিয়ের তারিখ ঠিক করে গেছিলো ওরা , এত ভালো পাত্রী হাতছাড়া করতে চায়নি আসলে, বাবা সেদিন লক্ষ্মীকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিল কিন্তু বাবা যে ছিল নিরুপায় । পাড়ার লোকের সাহায্যে , মায়ের ঘটে জমানো টাকা , বাসন- কসন দিয়ে ঠিক ৬ মাস পর লক্ষ্মীর বিয়ে হয়ে গেলো। মাত্র সাড়ে ষোলো বছর বয়সে লক্ষ্মী তখন কারো বাড়ির বউ , ভাবতেই আমার কেমন অবাক লাগে । এইসব বিয়ে সাদি , প্রেম ভালোবাসার চক্করে পড়তে চায়নি বলেই টিউশনের ১২ ক্লাসে পড়া দাদার প্রপোজাল রিজেক্ট করেছিল একদিন লক্ষ্মী , বেশ ভালো ছিল পড়াশোনায় ছেলেটি , লক্ষ্মীকে পড়াশোনায় সাহায্যও করেছে কিছুবার । লক্ষ্মীরও তার প্রতি ভালো লাগা ছিল বই কি! কিন্তু লক্ষ্মী জানতো তার সীমা ঠিক কতটা।

লক্ষ্মী আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে রান্না করতে আসে , লক্ষ্মী এখন এক বাচ্চার মা , সে ও এক মেয়ের মা , মেয়েটিও মায়ের মতনই সুন্দরী হয়েছে । অ ,আ , লিখতে শিখেছে সবে ,আর বেশ সুর টেনে টেনে কথাও বলে , মাঝে মাঝে ওকে আনে সঙ্গে করে , সেদিন আর লক্ষ্মী পাত্তা পায়না আমাদের কাছে , ওই মাতিয়ে রাখে আসর। ওর নাম রেখেছে প্রীতিলতা , নাম টি লক্ষ্মীর দেওয়া , স্কুলে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার – এর সাহসিকতার গল্পটি পড়েছিল সে , সেখান থেকেই এই নামকরণ।
লক্ষ্মীর শশুরবাড়ির পারিবারিক ব্যবসা দেখেই বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বেশ সচ্ছল অবস্থা ছিল ওদের , লক্ষ্মী বুঝেছিল বাবা তাকে একেবারে জলে ভাসিয়ে দেয়নি , কিন্তু লক্ষ্মীর প্রত্যাশাটা ছিল এর চেয়ে একদম অন্যরকম , এই সুখের সাথে সেই সুখের আকাশ – পাতাল তফাৎ । এক বছরের মধ্যেই লক্ষ্মীর শশুর মারা যাওয়াই ব্যাবসার হাল অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছিল , এখন তো আরো বাজে অবস্থা ওদের , কোনরকমে সংসার চলে , লক্ষ্মীর স্বামী অনেক খেঁটেখুঁটে চেষ্টা করছে ব্যবসাটাকে আগের মতন দাঁড় করানোর। নিজের জেদে লক্ষ্মী লোকের বাড়ি রান্নার – বান্নার কাজ করতে ঢুকেছে , প্রথমদিকে শাশুড়ি , স্বামী দুজনেই নারাজ থাকলেও এখন তারাও আর কিছু বলেনা , ওনারাও বুঝেছে এখন কার দিনে একজনের ইনকাম এ সংসার চালানো টা কতটা কঠিন । স্বামীর পাশে একটু হলেও দাঁড়াতে পেরেছে সে এই ভেবেই লক্ষ্মীর একটু স্বস্তি আসে ।
মা এখন টুকটাক কাজ করে , বাবারও ভালোই বয়স হয়েছে , তাই লক্ষ্মীর বাবা এখন বাজারের একটা মুদী দোকানে হেল্পার এর কাজ করেন। মেজবোনটারও দুবছর হলো বিয়ে হয়ে গিয়েছে , ছোটো বোনটা টিউশন পরিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচা চালায়। বাবাকে তাদের এই অবস্থার কথা জানায়নি লক্ষ্মী , বাবাই বা কি করতো , শুধু শুধু কষ্ট পেতো । লক্ষ্মী মাঝে মাঝে গিয়ে দেখা করে আসে , কিন্তু তারা আসেনা এ বাড়িতে তাই জানতেও পারেননা ।
প্রীতিলতা কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন লক্ষ্মীর যেগুলো ওর একান্ত নিজের জন্য ছিল সেগুলো এখন প্রীতিলতা কে নিয়ে জল বুনছে । কেঁদে ফেলে ও এগুলো বলতে বলতে , কষ্টে বুক ফেটে যায় ওর তারপর আবার বলে ওঠে ;
– আমার মেয়েটা একদিন আমার এই সব চোখের জল মুছে দেবে , দেখো তোমরা।
আমরাও ওকে আশ্বাস দি ।
কিছুদিন আগেই আমার University এর Ma’am একটা assignment দিয়েছিলেন , প্রশ্ন ছিল এই যে 21 December , 2021 যে বিল টি পাশ হয়েছে , যেটি অনুযায়ী ভারতীয় মেয়েদের পুরুষ দের মতই , বিয়ের বয়স 18 থেকে 21 করা হয়েছে , তো এই সমন্ধে আমার কি মতামত ,অনেক ভেবেছিলাম সেদিন ঠিক কোনদিকে দিয়ে ভারতীয় মেয়েদের জন্য এই বিল টি লাভজনক। এই বিলটি নাকি Equality এর সাথে সাথে শিশুমৃত্যু , পুষ্টি – লিঙ্গ অনুপাত , বাল্য বিবাহ ,নারী শিক্ষা , বাচ্চা মেয়েদের মানসিক উন্নতি ইত্যাদি ইত্যাদিতে প্রভাব ফেলবে , জানিনা কতদূর কি হবে ।
সেদিনও assignment যা লিখেছিলাম আজও তাই লিখছি , আমার একান্ত নিজের মতামত ; যখন লক্ষ্মীর বিয়ে হয় , তখন সরকার দ্বারা মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারিত ছিল 18 বছর কিন্তু তখনও লক্ষ্মীদের গ্রামের মত এইরকম অনেক প্রতন্ত্য গ্রামে যেখানে সংবাদ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যম পৌঁছাতে পারেনা , সেই গ্রাম গুলিতে অনেক লক্ষ্মীরই এইরকম বাল্যবিবাহ এর আগুনে জ্বলতে হয়েছে । দিল্লি সুলতানদের রাজতন্ত্রের সময় থেকে ভারতে বাল্যবিবাহের প্রচলন , এটি প্রধানত মেয়েদের সুরক্ষার একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো এছাড়াও বিদেশি শাসকদের ধর্ষণ অপহরণ থেকেও বাল্যবিবাহ ভারতীয় বাচ্চা মেয়েদের রক্ষা করতো। আমরা এখন সবদিক দিয়েই স্বাধীন হলেও বাল্যবিবাহের মত অভিশাপের ফাঁদ থেকে আমরা আজও মুক্ত হতে পারিনি। ফুলের মত নরম ছোটো একটা মন যাদের কোনরকম দায়িত্ব এর সমন্ধে কোনো ধারণা মাত্র নেই এমনকি যারা তাদের সঙ্গীর নাম টুকু জানেনা , তাদের ঘাঁড়ে একটি ভারী বস্তার মত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় খুব সহজেই , অপরিণত বয়সে এত বড়ো একটি সিদ্ধান্ত শিশুদের পক্ষে অসম্ভব তাই আমার মতে বাল্যবিবাহ একপ্রকার জোরপূর্বক বিবাহ।
ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই সমাজের এই নিয়ম প্রভাবিত করলেও বিশেষ করে মেয়েদের এই জাঁতাকলে পিষতে হয়েছে সেই অতীত কাল থেকে।
আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যম গুলোর উচিত আরও বিশেষ ভাবে এক্টিভ হওয়া এবং “ বালিকা বধূ ” র মত আরো বিভিন্ন বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম এর দ্বারা শিশুদের তাদের মানবধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং জাগ্রত করে তোলা , যাতে ভবিষ্যতে তারা এই প্রকার মানবধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারে।
বিভিন্ন সার্ভের দেখা গিয়েছে লক্ষ্মীর মত , আমাদের দেশের প্রায় ২১ লক্ষ্য কম বয়সী মেয়েরা গর্ভবতী হয় যার একমাত্র কারণ এই বাল্যবিবাহ । তাহলে এই বিল কি আদেও এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে ?
আমার মনে হয় না । আমার মনে হয় , যতদিন না সরকার এই ব্যাপারটাকে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ততদিন এই অভিশাপ আমাদের গ্রাস করতেই থাকবে , সাথে সাথে সমাজের এই আমাদের মত সাধারণ মানুষদের আরও একটু বেশি করে এই issue টিকে নিয়ে ভাবা উচিত । লক্ষ্মীর মত গরীব বাবার মেয়েদের জীবনে কোনরকম পরিবর্তনই আনবেনা এই বিল , কারণ এ দেশের বাল্যবিবাহের কারণ গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো দারিদ্রতা , যতদিন না এ দেশের দারিদ্রতা ঘুচবে ততদিন এ দেশের বেশির ভাগ লক্ষ্মীর এইরকম বলিদান চলতে থাকবে , আর এই কঠিন দারিদ্রতার কাছে এই ধরনের বিল কোনদিনই পাত্তা পাবেনা ।
আমি ভাবি লক্ষ্মীর মত আত্মবলিদান দেওয়ার ক্ষমতা আর কটা মেয়ের থাকে , এটলিস্ট আমার তো একটুও নেই , লক্ষ্মীর মত লক্ষ্মী মেয়েরাই পারে পরিবার , বাবা এবং বোনেদের জন্য নিজেদের সব স্বপ্ন ধুয়ে ফেলতে । লক্ষ্মীর মত মেধাবী ছাত্রীরা আমাদের সমাজের ছাঁই চাঁপা আগুন ,ওদের ও অধিকার আছে এই দেশে বিনা বাঁধায় ধাউ ধাউ করে জ্বলে ওঠার।
আমাদের মত সুযোগ – সুবিধা পেলে ওরা যে কতদূর এগোতো তার ধারণা আমার , আপনার সবার ধরা – ছোঁয়ার একদম বাইরে।
এইরকম লক্ষ্মী জন্মাক সবার ঘরে ঘরে।
—–
Stay safe
BE HAPPY
Thanks a lot for visiting.
______


You must be logged in to post a comment.